পিরামিডের প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমেই যে দেশটির কথা মাথায় আসে তা হল মিশর। চারদিকে শুধু বালি আর বালি। মাটির গভীরে সেখানে প্রোথিত রয়েছে অপার রহস্যের খনি। ইতিহাস যেন প্রতিটি পিরামিডের নীচে শায়িত। শতাব্দীপ্রাচীন এক একটি পিরামিড রহস্য-রোমাঞ্চের খনি। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো পিরামিড নাকি তৈরি হয়নি মিশরে।
মিশরীয়দের হারিয়ে সেই তকমা কেড়ে নিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। সেখানে মাটির নীচে শায়িত রয়েছে ২৫ হাজার বছরের ইতিহাস। বয়সে মিশরের পিরামিড এই পিরামিডের কাছে নেহাতই শিশু। মিশরে অনেকেই বিশ্বাস করেন, পিরামিড মানুষের তৈরি নয়, ভিন্গ্রহের প্রাণীদের তৈরি।
এ রকমও প্রচলিত আছে যে, জাদুবলে পাথরে ওজন শূন্য করে ফেলে সেগুলি পর পর সাজিয়ে পিরামিড বানানো হয়েছিল। মিশর বিশেষজ্ঞদের মতে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ২ হাজার ৭০০ বছর আগে তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত গিজা পিরামিড। এর কাছাকাছি সময়েই তৈরি হয় জোসেরের পিরামিড।
ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম জাভায় সবুজ দিয়ে মোড়া এক পাহাড়ি অঞ্চল। এর মাঝে ইতিউতি পড়ে থাকতে দেখা যায় ছোটবড় অসংখ্য রহস্যময় পাথর। এই অঞ্চলে মূলত প্রাচীন জনজাতিদের বসবাস। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এটি একটি অতি পবিত্র স্থান। কিন্তু এর আসল রহস্য বহু দিন অজানাই থেকে গিয়েছিল।
বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, এখানে মাটির নীচে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে এক বিশাল পিরামিড। নাম ‘গুনুং পাডাং’। স্থানীয় বাসিন্দারা এই ধরনের স্থাপত্যকে ‘পান্ডেন বেরুনডাক’ নামে ডেকে থাকেন। নামের অর্থ ধাপে ধাপে ওঠা পিরামিড। এ অঞ্চলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের পা পড়েছে মাত্র এক দশক আগে।
তার আগে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে সুপ্রাচীন স্থাপত্যের অস্তিত্ব অধরাই থেকে গিয়েছিল। একে একটি পাহাড় বলেই জানতেন সে দেশের মানুষ। বিশেষজ্ঞেরা প্রথমে জানিয়েছেন, মিশরের পিরামিড, এমনকি স্টোনহেঞ্জের থেকেও পুরনো এই পিরামিড সম্ভবত মানুষের তৈরি সবচেয়ে প্রাচীন মেগালিথিক (একাধিক বিশালাকারের পাথর দিয়ে তৈরি) স্থাপত্য। অবশ্য সম্প্রতি সেই ধারণা নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করতে শুরু করেছেন গবেষকদের একাংশ।
২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ভূতত্ত্ববিদ, ভূপদার্থবিদদের একটি বিশেষ দল অভিযান চালায় এই অঞ্চলে। দীর্ঘ গবেষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ইন্দোনেশিয়ার ‘ন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন এজেন্সি’। ইন্দোনেশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সেসের ড্যানি হিলম্যান নাতাভিদজাজা এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং গবেষণাপত্রটি ‘আর্কিয়োলজিক্যাল প্রসপেক্টশন’ নামক একটি প্রবন্ধের আকারে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ড্যানি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছিলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরে জানা গিয়েছে আগ্নেয় পাথরের তৈরি পাহাড়ের গা কেটে এই স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল। রেডিয়োকার্বন ডেটিংয়ের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, তুষার যুগের শেষে তৈরি হয়েছিল এই স্থাপত্য। পিরামিডের মূল অংশটি বিশাল অ্যান্ডেসাইট লাভা দিয়ে তৈরি।
পিরামিডের প্রাচীনতম নির্মাণ উপাদানটি সম্ভবত একটি প্রাকৃতিক লাভা পাহাড়। তার পর সেটি কেটে কেটে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছিল এবং তার পর একে স্থাপত্যের রূপ দেওয়া হয়েছিল। ড্যানি জানান, গুনুং পাডাংয়ের গঠন বেশ জটিল এবং একই সঙ্গে অভিজাত।
এর সবচেয়ে গভীর অংশ মাটির থেকে ৩০ মিটার নীচে। ড্যানির দাবি, পিরামিডের কেন্দ্রস্থলটি খ্রিস্টপূর্ব ২৫ হাজার থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৪ হাজার বছরের মধ্যে তৈরি। কিন্তু তার পর দীর্ঘ দিন সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৭৯০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬১০০ বছরের মধ্যে এর কাজ চলে।
চূড়ান্ত নির্মাণকাজ চলে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ বছরের মধ্যে। পিরামিডের উপরিভাগের এই অংশটিই বর্তমানে কিছুটা দৃশ্যমান। পিরামিডের পরিকল্পনাও অত্যন্ত জটিল ধরনের।
এর সবচেয়ে গভীর অংশটি মাটির প্রায় ৩০ ফুট নীচে রয়েছে। এ ছাড়াও এর ভিতরে রয়েছে বিরাট আকৃতির বেশ কয়েকটি গুপ্ত কক্ষ, যার সব ক’টির রহস্য সমাধান করা সম্ভব হয়নি। একটি নতুন গবেষণাপত্রে গবেষকদের একটি চমকপ্রদ দাবি উঠে এসেছে।
তাঁরা বলছেন ইন্দোনেশিয়ার গুনুং পাডাং পিরামিড খ্রিস্টের জন্মের আনুমানিক ১৬ হাজার থেকে ২৭ হাজার বছর আগে নির্মিত হয়েছিল ঠিকই, তবে এই নির্মাণটি আদৌ মানুষের তৈরি কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তাঁরা।
সাদার্ন কানেকটিকাট স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রত্নতাত্ত্বিক বিল ফারলি বলেছেন যে, গুনুং পাডাং থেকে প্রাপ্ত ২৭,০০০ বছরের পুরনো মাটির নমুনা থেকে কাঠকয়লা বা হাড়ের টুকরোর মতো কোনও উপাদান পাওয়া যায়নি।
এই ধরনের উপাদান সেখানে মানুষের কার্যকলাপের অস্তিত্ব প্রমাণে সহায়তা করত বলে জানান তিনি। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, জটিল এই স্থাপত্যটি বৈচিত্রে ভরা।
গবেষণাপত্রে লেখা হয়েছে, গুনুং পাডাং বিভিন্ন সময়ে একাধিক বার বিভিন্ন গোষ্ঠীর দখলে এসেছে। তাদের প্রভাবে এর স্থাপত্য ও আকারে পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে এই পিরামিডের প্রতিটি কোনায় লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস। তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার অনলাইন
Comments
Post a Comment